সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা

Sayan Dutta, 19MS

03/09/2019

যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।

[ যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা, তাঁহাকে নমস্কার । তাঁহাকে নমস্কার । তাঁহাকে নমস্কার , নমস্কার , নমস্কার । ]

[ ১ ]

আজ মহাপঞ্চমীর শেষ বিকেল ।

দুগ্ধশুভ্র কাশ ও শরৎ এর মেঘ এর তাকিয়ে চলতে থাকে কাব্যচর্চা , বাতাস আন্দোলিত হতে থাকে দুর্গাপূজার মৃদু গন্ধে - আমার দূর্গাপূজা , আপনার দূর্গাপূজা , উৎসবের আনন্দে উন্মাদ হয় থাকা শত সহস্র বাঙালির দুর্গাপূজা ।

স্কুলগুলি তে আজ ছুটি পড়েছে , উৎসবের আনন্দে আত্মহারা শিশু সন্তানেরা সন্ধ্যার পাখিদের মত বাসায় ফিরছে । উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠা বাঙালির দুর্গাদর্শন এ ও সন্ধের ছায়া পড়েছে , তারা ও বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছে ।

শহরের স্বল্প বিখ্যাত এক রেস্তোরাঁয় আজ মানুষের স্রোত বয়ে যাচ্ছে - উৎসবের আনন্দের বিলাসী হাতের স্পর্শ তার গায়ে ও লেগেছে ।

রাম ও রহিম - রেস্তোরাঁর দুই স্বল্পবয়স্ক কর্মচারী - রেস্তোরাঁয় আসা মানুষ ও তাদের চাহিদার ভার সামলানো ই যেন এই দুজনের একমাত্র কাজ । রেস্তোরাঁর অলংকার , টুনি বাল্ব এর ঝলমলে আলোর তলায় বেঁচে আছে এই দুজনের অন্ধকার জীবন ; পূজার এই ঝলমলে রং ও তাদের এড়িয়ে চলে ; বঞ্চনা যেন একঘেঁয়েমি হয়ে বেঁচে থাকে ; সময়ের রেলগাড়ির চাকায় তারা অনবরত পিষ্ট হয় , কিন্তু ধাবমান রেলগাড়ি তাদের জীবনকে আন্দোলিত করতে পারে না ।

প্রতিদিনের নীরস জীবনযাত্রার পর তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয় - সামান্য কিছু অর্থ , যা তাদের চাহিদার তুলনায় কম , এবং প্রাপ্যের তুলনায় অধিক কম ; সঙ্গে মেলে দুপুরে ও রাতে নিম্নমানের সামান্য অন্ন । বঞ্চনার কাহিনী শুধুমাত্র এইটুকু ই নয় - এর তুলনায় লক্ষ গুন বেশি - নিছক পৃষ্ঠায় তার ছবি আঁকা অসম্ভব ।

প্রতিদিন সন্ধের এই সময়টায় রাম ও রহিম তাকিয়ে থাকে স্কুল ফেরত শিশুগুলির দিকে । আজ মহাপঞ্চমীর সন্ধ্যায় মানুষের স্রোত তাদের কর্মের দিকে ঠেলে দিয়েছে । একটি বৃহৎ যন্ত্রের ছোট্ট এক অংশ যেমন যন্ত্রটির সাফল্যের লক্ষে অনায়াসেই তার নিজস্বত্ব ত্যাগ করে বসে , মানুষের প্রয়োজনের স্বার্থে আজ এই দুই স্বল্পবয়স্ক বালক ও যেন তাদের নিজস্বত্ব বলিদান দিয়ে প্রতিষ্ঠান কে ই পূর্ণতা দান করার চেষ্টা করে চলেছে ।

[ ২ ]

সারাদিনের ঘোরাঘুরি তে ক্লান্ত চার বন্ধু একটি রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে - গায়ে ভদ্রলোকের ছাপ , ভাবে শিক্ষিত লোকের ছোঁয়া - তাদের আলোচনার ভাষা অধিকাংশ ই বিলিতি , বিষয়বস্তু তে আভিজাত্যের ছাপ । রেস্তোরাঁয় বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটি টেবিল মিলতে ই তারা সেই টেবিলের দিকে ছুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি খাদ্য পরিবেশনের আদেশ জানালো । তাদের আদেশ সামলানোর ভার বহন করে চলেছে দুই নিষ্পাপ বালক - এই শিক্ষিত , অভিজাত চার বন্ধু এই দুজনের কথা ভেবে ও দেখে না , তাদের নামটি ও এদের অজানা ।

খাদ্য পরিবেশিত হতে ই তারা তার সদ্ব্যবহারে মেতে ওঠে - সঙ্গে চলে নানা রঙে রাঙানো কিছু আলোচনা । কখনো কীটস ও শেলীর কাব্যগুণের জোর প্রশংসা চলে ; কখনো বা তারকস্কি ও কিউব্রিক এর মধ্যে কে সেরার আসনের দাবিদার , সেই নিয়ে তুমুল তর্ক হয় । বিষয়বস্তু সংগীত এর দিকে এগিয়ে আসতেই একজন মোজার্ট এর সারল্যের প্রশংসা করে বেটোফেন কে তার পেছনে ঠেলে দিতে চায় - ওমনি বাকি তিনজন রে রে করে উঠে ব্যাচ ও বেটোফেন এর জয়গান গাইতে লাগে , শেষে ৩:১ এর গণতান্ত্রিক পরাজয় মেনে নিয়ে এই মোজার্ট ভক্ত টি চুপ হয়ে যায় । ধীরে ধীরে রাজনীতির আঁশটে গন্ধ মাখে তাদের আলোচনা - মার্ক্স ও লেনিন এর দর্শন নিয়ে তারা চর্চা আরম্ভ করে । খুব শীঘ্র ই আলোচনার বিষয়বস্তুর সাথে সাথে তাদের খাওয়া ও শেষ হয়ে আসে ।

[ ৩ ]

মানুষের ভিড়ে তিক্ত মানুষ নিজে ই - অপেক্ষা করতে ও নারাজ তারা । তাদের স্রোত সামলাতে ব্যস্ত রাম ও রহিম দেখতে পেল , অবশেষে একটি টেবিল ফাঁকা হওয়ার অপেক্ষায় । খাবারের দাম ও টিপ মিটিয়ে দিয়ে চার বন্ধু বেরিয়ে যেতে ই রাম দেখতে পেল , ওই চার বন্ধু মিলে শেষের দিকে নেয়া ছয় টি টুকরো মাংস আর শেষ করে উঠতে পারে নি ।

রহিম ও হাঁ করে এই লোভনীয় খাদ্যের দিকে ই চেয়েছিল । তারা একটি চটজলদি ফন্দি আঁটে - নষ্ট হওয়া মাংস গুলি ফেলে না দিয়ে তারা সেগুলিকে নিজেদের জন্য সরিয়ে রাখে ।

আজ মহাপঞ্চমীর রাতে তারা উপরি পাওনা ভোগ করবে ; উৎসবের আনন্দের শীতল হাতের ছোঁয়া ই তারা কেঁপে ওঠে - আনন্দে , না উত্তেজনায় , কে জানে !

[ ৪ ]

দুগ্ধশুভ্র কাশ ও শরৎ এর মেঘ এর তাকিয়ে কাব্যচর্চা চলতে ই থাকে ...