অর্চিস্মিতা মিশ্রের পাঁচটি কবিতা

Archismita Mishra, 10MS

25/09/2019

অবসর

দক্ষিণে ঝুলবারান্দা, আরামচেয়ার

লেবুগন্ধ কমলালেবু রোদ-

ছোট্ট টেবিলে ধুলোপায়ে বসেছেন

সুধীন্দ্রনাথ, ওমর খৈয়াম;

বিদেশী চকলেটে রীতিমতো নৈবেদ্য রেখেছি...

বাঁদিকের চেয়ারটা আমার

(এখনো তো বাঁদিকেই হাঁটি, ছায়া পড়ে)

ফিরোজা কুশনে হেলান-

সেঁকে নেওয়া শ্রান্ত ফুসফুস

পুবে স্বর্ণচাঁপা,

রেলিঙের গায়ে গায়ে অবসন্ন রেণুসঞ্চার-

সোডিয়াম ল্যাম্পের হলুদ আলোয়

কোনো কোনো রাতে স্বর্ণবৃষ্টি নেমে এলে

দাঁড়াবো জানালায়;

আমরা দুজন ভিখারী...

আর হাত পেতে চাঁপাধোয়া জল নেবো

আতপ্ত কপালে

পশ্চিমে শোওয়ার ঘর।

দেওয়ালে মুচকি হাসে ল্যাভেন্ডার নোট-

ওষুধ- রুটিন, খাওয়ার আগে ও পরে ইত্যাদি!

মেঝেতে শীতলপাটি;

খানকয় আলমারি...

টিমোথি ফেরিস, লিজ়া রান্ডাল,

মিজ়লার, পোপ, সাগান ও ডকিন্স

উত্তরে হিমহাওয়া, ব্যাধিজরাভয়

কখনো আলসেমি করে আধপাল্লা খুলো-

বুড়ো নিমগাছ, অবাধ্য জোনাকি,

কখনো বা ডালে আটকানো

সুতোছেঁড়া মাছরাঙা ঘুড়ি

এভাবেই যে কদিন

এক্কাদোক্কা

এক্কাদোক্কা

বিসর্জন

এবার ফিরাও রাত্রি!

ধমনীতে শ্রান্ত উপবাস-

যেখানে আলোবালিকার চুলে তমিস্রাসম্ভাষ

যেখানে ত্রস্ত প্রেম, উল্কাস্তর ছেড়ে

নেমে আসে ক্ষতউন্মোচন;

সেখানে শুশ্রূষা রাখো, ব্যাঙ্গমীর স্নেহে

ডুমুরের ঝোল রেঁধে বেড়ে দাও

শিউলি-শিউলি ভাত-

খুদকুঁড়ো বলিষ্ঠ দুহাত

সান্ত্বনা শেখেনি যখন

সখা, স্রোতবান হও!

একালের ফল্গুমানব, হৃদিকারাগারে

ধূসর শিকল ছুঁয়ে বহমান হোক

তোমার আকুতি।

বিষাদঘ্ন, জঙ্গম হও-

হয়তো বা সাময়িক... আমাদের মূক স্থবিরতা

তবুও অতীত আসে, অল্পপ্রাণ গোধূলিবিন্যাস।

সবই বুঝি। বিলাসিতা।

আমি। তুমি। বিতস্তায় সূর্য- অভিসার।

প্রিয়, বিসর্জন দাও-

সায়াহ্ণের জ্যোৎস্নাগন্ধী জলে

নিরঙ্কুশ ডুবে ডুবে যাক

দেওয়ালের সপ্রশ্ন ইতিহাস!

শুরু হোক আমাদের শুকসারি দিন...

শুধু সমাপন

"সময়ের সন্তানেরা দৃষ্টিহীন হয়।" কানে কানে এসব কুকথা বলে মিলিয়ে গেলো স্রোতস্বতী। গুল্মলতা তার অভিমানী প্রশাখা হেলিয়ে বললে ''ভুল। সবটুকু ভুল।"

দাঁতে দাঁত চেপে সইলাম সব নির্জন রক্তপাত। নিরালা বঞ্চনা। রোদে পিঠ দিয়ে কমলালেবু ছাড়িয়ে খেতে খেতে ভেবে নিলাম ''এসব রূপকথা। সত্যি সত্যি কষ্ট পেলে কি আর ক্ষমা করতে পারতাম?''

ভাবতে ভাবতে চারাগাছেদের ঝুরি নামলো। আমার চুলে জট পড়লো। দূর্বাদলশ্যাম মেঘের দল আহ্লাদে নিবিড় হয়ে এসে ধারাজলে বেহালা বাজালো আতপ্ত শরীরে। উঠোনের কোণে মায়াবী হলুদ ঘাসফুলে আবারো কুঁড়ি এলো।

ততদিনে যন্ত্রণার মুহূর্তেরা ধাওয়া করেও আর নাগাল পাচ্ছেনা আমার। আমার আঁচল জুড়ে তখন রেশমী অন্ধকার। কপাল জুড়ে শ্বেতচন্দনের শীতলপাটি। অনুভব জুড়ে রাত্রি নেমেছে, স্রোতের গহীনে মায়াবিলাস।

আমি দেখতে পাচ্ছি জরাব্যাধি পেরিয়ে ক্ষমার ব্যাপ্তি। দেখতে পাচ্ছি ছাতিমফুলের গন্ধে উদ্বেল জ্যোৎস্নারাত ধুয়ে দিচ্ছে আমার উন্মুক্ত ক্ষতস্থান।

দৃষ্টিহীন নই, নদী, আমি দৃষ্টিহীন নই। আমি সময়জাতিকা নই। আমি শুধু 'ক্ষমা' হতে চেয়েছি চিরটা কাল।

আশিয়ানা

কোনো কোনো শনিবার ভাতঘুম ভেঙে যায় এক অপার্থিব বৃষ্টির শব্দে। কয়েকদিন ধরেই কমবেশি রুমঝুম, দানিয়ুবে বিপদসীমা প্রায় অতিক্রমের অশনিসংকেত। তবু ঘুম ভেঙে কেন যেন অবাক হয়ে যাই।

উঠোন জুড়ে বেগুনি উইস্টেরিয়া ফুলের গালচে কোল পেতে নিচ্ছে অমরাবতীর ধারাজল।

ঘুম ভাঙলে খিদেও পায়। রান্নাঘরে যাই, আলো জ্বালতে ইচ্ছে করে না। সুইটকর্নের ছোট্ট টিন খুলি, শশাকুচি লেবুর রস চাটমশলা দিয়ে মেখে আনি। ফের পা ঢুকিয়ে দি সবজেনীল লেপের ওমে।

ছোটবেলায় বৃষ্টি হলেই লোডশেডিং হতো, সন্ধ্যে থেকে পড়াশুনো শিকেয় তুলে মা মেয়ে কতসব গল্প জুড়েছি। অন্ধকারে দুজনে দুজনের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কখন যেন অসমবয়সের আগল ভেঙে তা হয়ে যাচ্ছে চিরকালের মেয়েদের গল্প। মায়েদের গল্প। পায়ের কাছে কোনো এক তুলোর বল ঘুমিয়ে আছে নরমগরম। বাবা ফিরে লম্বা কালো ছাতা মেলে দিচ্ছে বারান্দায়, আমি একখানা ইমারজেন্সি আলো ধরে আছি মায়ের রুটি গরম করা শেষ হওয়া অব্দি।

বৃষ্টি হলেই তাই আজো আমার লোডশেডিং পায়।

আমার একলা ঘরে লোডশেডিং নেই। টিউব, বাল্ব বাদ দিলেও আছে ঘরবদলের পর নিজের পছন্দ করে আনা অলিভসবুজ টেবিলল্যাম্প। আছে 'তার' পাঠানো ঘিয়েরঙা ফুলকাটা লম্বা ল্যাম্পশেড, যার ভেতরের আলো জ্বললেই গায়ে ফুটে ওঠে নক্সীকাঁথা।

তবু ভিতরঘরে মায়ামুকুরে যার ছায়া পড়ে সে বুঝি আমি নই। এত আলোর মাঝেও মন উচাটন, কানের মধ্যে বুকের মধ্যে শিরার মধ্যে চোরা ফিসফাস। 'ফিরে আয়, ফিরে আয়'।

সাটিনের হলুদ পর্দার ফাঁকে অন্ধকার ডুবে যাচ্ছে বৃষ্টির শরীরে। রসে টুপটুপ লাল চেরির মাখনত্বক বেয়ে অথৈ নামছে গোটা শহরের অকালশ্রাবণ।

হাতে ধরে রাখা বইটির অক্ষরমালায় ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে অকারণ অভিমান। স্থিতি আসছে। স্থিতি চলে যাচ্ছে।

গন্ধরাজের সুবাস ঠিক ঠাহর করতে পারছিনা। তবে উপেন্দ্রকিশোরের শিশুরামায়ণের শুরুর চিত্রকল্প ভেসে উঠছে কোন মাদুরপাতা শাওনবেলার সুখে:

''সোনা-মণি-মুকুতায় করে ঝলমল/ ছায়া লয়ে খেলে তার সরযূর জল''

ছোট্ট আমি হারমোনিয়ামের রীড একটা একটা করে টিপে গাইছি, সুরে ঠিকভুল যাই হোক, প্রাণের উৎস থেকে গাইছি:

''ভীত বন উপবন লুটায়ে লুটায়ে/ প্রণতি জানায় সেই বিজয়ীর পায়ে/... .../বরষা ঋতু এলো এলো বিজয়ীর সাজে"

চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি সেই বিজয়ীর উত্তরীয়ের আভাস। ইনিই কি তবে ভিক্ষু আনন্দ? বর্ষার ছদ্মবেশে? কিশোরীমনে নজরুল মিশে যাচ্ছেন রবীন্দ্রদর্পণে।

ল্যাপটপে মেলা কাজ পড়ে থাকে। সুগন্ধী-বিজ্ঞান নিয়ে এক বক্তৃতার প্রস্তুতি নিতে নিতে খুঁড়ে দেখতে ইচ্ছে করে স্মৃতিবিস্মৃতির অলক্ষ্য সাকিন।

''করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে...''

মহাদেশের পর মহাদেশ পেরিয়ে আমার কিশোরীদিন অপেক্ষা করে থাকে। আমার শাঁখের দুল, আমার প্রবালের মালা। আমার খাতার পিছনের ছেলেমানুষি। আমার অসতর্ক ভুল, আমার অসহায় আক্ষেপ। আমার আদরের পীচরঙা গোলাপের গাছ।

হারায়না সেই পথ। ফুরোয়না সেই বৃষ্টি। বুকের ভেতর মন পাতলেই মেঘের পালকে চড়ে পৌঁছে যাই সেই আয়নামহল। গান্ধর্বী কানে দেন বীজমন্ত্র:

''...মনে হয় যে পাব খুঁজি/ ফুলের ভাষা যদি বুঝি/ যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে/ মন, মন রে আমার॥" আমায় গ্রহণ করে রোমাঞ্চ। আমি সত্য হই। সার্থক হই।

আশিয়ানা। আশিয়ানা।

হৃদয়বাঁশি

অস্ফুটে বলে গেলে, 'কবিতার জন্য ঘর চাই।' কিন্তু লেখার ঘর তো তোমার অফুরান। এঘর ওঘর সেঘর পেরিয়ে ঝুলবারান্দা জলসঘর পাতালঘর গোঁসাঘর চিলেকোঠা। তবে বুঝি কবিতার আস্ত একখানা বসতবাটি চাই?

তুমি উঠে গেলে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার ফেলে যাওয়া মেহগনি রঙের চেয়ার অর্ধেকটা ঢেকে আছে তোমারই ধূসর সোয়েটারে। আমাদের চিঠিগল্পের মতোই পুরোনো এ সোয়েটার। ঊলের ঘরগুলোর ফাঁক বেড়েছে, মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ধর্মভীরু স্তাবকের মতো কুণ্ঠাগর্বী রোদ। সামনের তেপায়া টেবিলে কিছু অদরকারী বইয়ের সুঠাম জ্যামিতি। অচুম্বিত কফিকাপের অভ্যস্ত অভিমান।

গায়ের শৌখিন ওভারকোট ছেড়ে ওই ছেড়ে যাওয়া সোয়েটারের ধুলোওম জড়িয়ে শুয়ে যেতে সাধ যায় গুটিসুটি বিড়ালের মতো। আরশিনগরে নিন্দে রটে। কিন্তু আমি যে চিরকালের বেহায়া! আমায় অক্ষর দিলে শব্দ চেয়েছি, শব্দ দিলে বাক্য। বাক্য দিলে বিন্যাস আর বিন্যাস দিলে সংযম।

তুমি বলেছিলে, কবিতার জন্মক্ষণে খুলে আসতে হয় কবচকুণ্ডল। তাই সরিয়েছি অবহেলার নির্মোক আর উপবাসের দর্প। এই পারে খুলে রাখলাম অসময়ের চাপল্য আর পরিহাসের শব্দকীট।

"মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বম্/ হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্বম্!"

করপুটে রেখেছি উদাসীন তৃপ্তি আর আগ্রহী ক্ষমা। শব্দের উৎসবে নাকি একা হয়ে যাওয়াই বিধেয়। শুদ্ধচিত্ত, শুদ্ধবাস। রাত্রির তৃতীয় প্রহর চাঁদের রেকাবি এনে বেণীতে সাজায় কুয়াশাস্নিগ্ধ মায়াফুল। বহুদূরে পুতুলের ছোট্ট সাদা পাঞ্জাবিতে গাঢ় সবুজ সুতোয় ছোটবড় ফোঁড় তুলছে এক আনাড়ি সদ্যকিশোরী।

সেভাবেই অক্ষরসম্ভাষে জন্ম নেয় শব্দ আর শব্দদাক্ষিণ্যে বাক্য। বাক্যবিন্যাসে সঙ্কট পেরোয় আমাদের অগোছালো এক্কাদোক্কা শরিকি উদ্বেগ।

সুভগা নারীর মতো স্থিত হয় কাব্যের বাসনাশিকড়।

শহরের শেষতম জেগে থাকা চোখ প্রায়শঃই খুঁজে পায় তার একান্ত ব্যক্তিগত নক্ষত্র।

তুমি কাছে এলে বিরহ শুদ্ধতর হয়, জানো?