"আর উপায় নেই। সেই সকাল থেকে দুটো পাথর নিয়ে কোণায় বসে কি যে খুটখাট করে যাচ্ছে লোকটা। একে আর দলে রাখা যাবে না।" - বললো যে লোকটা, তার বেশ ঘাড়ে-গর্দানে শক্তিশালী চেহারা। সঙ্গে হ্যাঁয়ে হ্যাঁ মেলাচ্ছে যারা, তারাও সব জোয়ান পুরুষ। আর যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সে একটু দুর্বল মতো, সাতে-পাঁচে নেই ধরণের আচার-আচরণ। শুধু তার মতো যন্তরের কাজ এ তল্লাটে আর কেও পারে না। তাকে দল থেকে বাদ দিলে বল্লম-কুঠার-ছুরির একচেটিয়া প্রাধান্য হারাতে হবে তাদের- এই ভয়ে এতদিন কিছু বলা যায় নি। কিন্তু এই নতুন পাগলামি আর নেয়া যাচ্ছে না, দিন রাত হরেক রকম পাথর নিয়ে অন্ধকার কোণায় বসে খুটখাট আর ঘুটঘাট। অকারণ সবাই কষ্ট করে খাবার নিয়ে আসবে, আর একটা পেট কিচ্ছুটি কাজ না করে খেয়ে চলবে - তাই কখনো হয়? এইবারে তাকে দল থেকে বেরোতেই হবে।
এরকম ঘটনা যে হয়েইছিল, এমন কথা ইতিহাস বইতে লেখা নেই। কিন্তু হয়নি যে- এমন কথাও কেউ হলফ করে বলতে পারে না। বরং, মানুষের যা চরিত্র - এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কতজন এমন খুটখাট করা পাগল লেগেছিল আগুন আবিষ্কার করতে, তা জানা নেই। কিন্তু সেই আপাত অকর্মণ্য লোকটির অসংখ্য ফলহীন চেষ্টার জন্যই যে আজ আমরা সভ্যতার চালকের আসনে, সে জন্য তার অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। আরও বেশি করে সাধুবাদ প্রাপ্য ওই বাকি জোয়ান গাঁট্টাগোট্টা লোকগুলোর, যারা 'অকারণ' ভরপেট খাবার জুটিয়ে গেছিল সেই 'পাগল'টির। অনেকে আগুন আবিষ্কারকে বলেন বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সূচনা। কারণ সেই প্রথম মানুষের অনুসন্ধিৎসা রূপ পেল শক্তিতে। সেই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে নব নব প্রযুক্তিতে ব্যবহার করে উন্মেষ ঘটে সভ্যতার।
চন্দ্রযান২ নাকি ৯৫% সফল। ৫% ব্যর্থ। চন্দ্রযান এর ল্যান্ডার 'বিক্রম' ও রোভার 'প্রজ্ঞান' কাজ না করলেও আগামী সময়ে চন্দ্রযান পাক খেয়ে চলবে চাঁদকে। তার কাছেই জমা পড়বে যাবতীয় তথ্য। কিন্তু, ইসরোর বিজ্ঞানীদের সাফল্য ও ব্যর্থতার সংজ্ঞা আর আপামর জনতার কাছে সাফল্য ও ব্যর্থতার সংজ্ঞা নিশ্চিতভাবে এক নয়। কিন্তু চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ছোঁয়ার যে দুর্লভ কৃতিত্বে দেশবাসী গর্ববোধ করছিলেন, সেই আঙ্গিকে হার মেনেছে চন্দ্রযান২। ৯৭৮ কোটি টাকার এই প্রজেক্ট এর এহেন "ব্যর্থতা" নিয়ে মুখ খুলেছেন বহু বিচক্ষণ মানুষ। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের এহেন বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা শুধু দুরূহই নয়, বাতুলতা - মত বহু বিশেষজ্ঞের। কিন্তু আজ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বিজ্ঞান, তার প্রয়োগ এবং তার ব্যর্থতা নিয়ে কিছু আলোচনা বোধহয় একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
প্রথমেই আসা যাক 'ব্যর্থতা'র প্রসঙ্গে। প্রথাগত বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ অসাফল্যের ইতিহাস। 'ব্যর্থ' শব্দটির প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলাম এই কারণেই, যে প্রতিটি অসফল পদক্ষেপ আসলে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীকে তার অভীষ্টের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে দেয়। এই কথা কারোই অজানা নয়, কিন্তু আজ বোধহয় বিজ্ঞানের স্বার্থেই সবাইকে আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। খাঁটি ব্যোমকেশীয় কায়দায় একজন বিজ্ঞানী একে একে সমস্ত বেঠিক ধারণা, অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টাকে বাদ দিয়ে সত্যের পাদমূলে উপস্থিত হন। আমি নিশ্চিত, ব্যোমকেশ এবং অজিত এর সম্ভাব্য অপরাধীদের লিস্ট করে তাদের জেরা করাকে পাঠক ব্যর্থতার অভিধা দেবেন না।
দ্বিতীয়তঃ, রিসোর্স। অসফলতা কিংবা সাফল্যের খাতিরে কিছু প্রাথমিক ব্যর্থতা কে হয়তো মেনে নেয়া যায়, কিন্তু তার ফলে যে বিপুল সম্পদ বা সংস্থান এর অপব্যয় হয়, তার আলোচনাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একক সাধনার সীমা ছাড়িয়ে আর সমস্ত মানুষজাতি এক সামগ্রিক সাধনায় ব্রতী। তা যেমন শিল্প, প্রশাসন এর জন্য সত্যি, তেমনই বিজ্ঞানও তার ব্যতিক্রম নয়। সুইসদেশের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা ইউরোপীয় গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেকশন কিংবা ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রজেক্ট এ ব্ল্যাক হোল এর ধরা পড়া : সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের অনন্য নজিরগুলি সবকটাই অনেক বিজ্ঞানীর একত্রিত কর্মফল। আর এই জাতীয় বিপুল প্রচেষ্টার বিরাট অর্থভার বহন করে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের গভর্নমেন্ট গুলি এবং কিছু বহুরাষ্ট্রীয় সংস্থা। বলাবাহুল্য, তার অধিকাংশটাই একসময় আমার আপনার পকেটে বাস করতো। তাই এই অর্থব্যয়ে আমাদের লাভ কতটুকু? এই প্রশ্নের অবতারণা।
সেই প্রশ্নের আলোচনাতেই তৃতীয় ও অন্তিম প্রসঙ্গ : বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতিপর্বে রচনা সাজেশনে অবধারিত ভাবে আসতো 'দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান'। তাতে সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাত্রে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সমস্ত রকম প্রায়োগিক আঙ্গিক থেকে বিজ্ঞানের ভূমিকা লিখতে হতো। কিন্তু, হয়তো ছোট বলেই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পার্থক্য নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয়নি। বিজ্ঞান, তার আক্ষরিক অর্থে, সবসময়েই জ্ঞানাভিলাষী। তার উদ্দেশ্য অজ্ঞানতার অন্ধকার কে দূরীকরণ। তার চরিত্র সদা কৌতূহলী। চলার পথে, তার অনুসন্ধিৎসার ফলে হয়তো মানুষ কিছু নতুন তথ্য নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছে যার উপযোগিতা মানুষ্যজীবন কে করেছে সরলতর, তার বাধাকে সরিয়ে পথ কে করেছে উন্মুক্ত। কিন্তু বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য তাই ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল শুধুই জানার ইচ্ছা। সেই শুদ্ধ জিজ্ঞাসু মন ছাড়া, সেই অনুসন্ধিৎসা ছাড়া প্রযুক্তি কোনদিনই নতুন যুগের উন্মেষ দেখতে পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। অজানাকে জানার চিরকালীন আগ্রহে অগ্নিসংযোগ না করলে তাই প্রযুক্তির জয়রথ ও যাবে থেমে। সেই আগ্রহের পথে প্রতি পদে আছে বাধা, অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে অসফলতার সম্ভাবনা। তাই সেই রঙও গায়ে মেখে নিতেই হবে: কারও ঐকিক দায়ে নয়, জনসমাজের সামগ্রিক সন্নিপাতে।