জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলার স্বভাব আমার আছে--- সে আমি জানি। তা বলে আস্ত একটা আয়না উবে যায় কেমন করে? গত তিনদিন ধরে গোরুখোঁজা করেছি, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি ---- তারা বলে, " আমরা নিজেদের আয়নার খবরই জানি না, তোমারটার খবর জানবো ক্যামনে বাপু!!,... যাও, যাও!!... বাজে বকিও না।"
চাইলেই একটা নতুন আয়না কিনে ফেলা যায়, কিন্তু ওই ঈশ্বর গুপ্তের কাঁচের দোকানটা খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। শুনেছি,তিনি নাকি দোকান উঠিয়ে কোথায় যেন চলে গেছেন। আয়নাটা কে কিনে দিয়েছিল, তা কিন্তু জানা নেই। তবে এটা বলতে পারি ---- জন্মের সময় থেকেই ছিল, আয়নার কাঠের খোলসের এক কোণে শুধু লেখা ছিল ঈশ্বর গুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি। কিন্তু অন্য সমস্ত সাধারণ আয়নার মতো এটা শুধু মুখ দেখানোর কাজ করত না। এ ছিল সাক্ষাৎ মায়ামুকুর,সমস্ত কিছুর বিচার - বিশ্লেষণ করে সত্যি-মিথ্যের পার্থক্য করতে পারত, আবার সুখে- দুঃখে , বিপদে- আপদে, আবেগে- ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আয়না-ই ছিল পথ চলার সঙ্গী, সমাধানের সূত্র সন্ধান করতে পারত সে। একটু কাব্যিক করে বলতে গেলে---
এই আয়না ছিল ছোটোবেলার রংমহল, কৈশোরের আবেগ বিসর্জনের গঙ্গা, যৌবনের রণসজ্জা পরিধানের প্রধান হাতিয়ার আর বার্ধক্যে --- এটাই ছিল কুঁচকে যাওয়া মুখগুলোর প্রধান শত্রু। কিন্তু জীবনচক্রে এখন "পিউপা" দশা থেকে উদ্ধার ঘটেছে আমার ; এই সময় আয়নাকে আমি কেন শত্রু ভাবতে যাব? তাই প্রবল ভাবেই বোঝা যায় ---- আমি ইচ্ছে করে হারাইনি, ওটা হারিয়ে গেছে।কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না।কাউকে দিয়ে দিলাম কিনা ---- তাও তো মনে পড়ছে না। অগত্যা অচেনা এক পড়শিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, "আপনি কি জানেন আয়নাটা কোথায়?"
হেঁয়ালি করে উত্তর এল ,"কেনাবেচার গণ্ডিবদ্ধ জীবনে, যেখানে বেচে দিয়েছিলে ভালোবাসা, সেখানেই হারিয়েছিলে আয়নাটাকে।"
বললাম,"মানে!!!"
সে বলল,"আমি"
আবার প্রশ্ন করলাম,"আমি কে?"
প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই , সে শোনাল একটা গল্প;
বলল----
"অনেকদিন থেকেই
আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর
বদলে পাহাড়ই কিনতাম।
কারণ আমি ঠকতে চাই।
নদীটাও অবশ্য আমি কিনেছিলাম একটা দ্বীপের বদলে।
ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।
সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।
শৈশবে দ্বীপটি ছিল বড় প্রিয়।
আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার কাছে মাপে ছোট লাগলো।
প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।
বন্ধুরা বললো, ঐটুকু একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড় একটা নদী পেয়েছিস?
খুব তো জিতেছিস মাইরি।"
এতদূর পর্যন্ত শুনে আমি তাকে থামিয়ে বললাম---- "এতো সুনীলের কবিতা, এর সঙ্গে আমার আয়নার সম্পর্ক কী?"
সে বলল,"ওই দ্বীপ-ই ছিল তোমার আরশিনগর, তোমার শৈশবের রঙমহল, কৈশোরের গঙ্গা, আর যৌবনের হাতিয়ার, সে তো তুমি বিনিময়ে দিয়ে ফেলেছ----- আর তো খুঁজে পাবে না!"