"কি ভাবছো?"
মনির প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলো সোম। ওরা দুজন মনির ঘরে বসে গল্প করছিলো । মনি খাটের উপরে পা তুলে বসে, আর সোম জানলার ধারে চেয়ারে।
"এই যে জানলার বাইরে থেকে মহালয়ার স্তোত্রপাঠের আওয়াজ ভেসে আসছে, শুনলেই কেমন মন উদাস হয়ে যায়! ছোটবেলার সেই কলোনির দিনগুলো মনে পড়ে যায়। "
"কি আশ্চর্য না? আমরা দুজন একই টাউনে বড় হয়েছি। কিন্তু ওই ছোট্টো শহরে কেউ কাউকে চিনতাম না! আলাপ হলো এই বিশাল শহরে কলেজে পড়তে এসে!"
ব্যাপারটা কিছুটা আশ্চর্য হবারই মতো - সোম মনে মনে ভাবে। ও মনির থেকে চার বছরের বড়। হিসেব মতো ওর এতদিনে কলেজের গন্ডী পাড় করে যাওয়ার কথা। কিন্তু ও প্রথম দুবছর অঙ্ক পড়ে, তারপর ভালো না লাগায় রসায়ণ পড়তে ঢোকে । সেখানেই departmentএর fresher's welcome এ মনির সাথে আলাপ।
ও অঙ্কে ফল ভালোই করছিলো । বাড়ির লোকেরা, বন্ধুরা অনেক বুঝিয়েছিলো এভাবে নিজের পায়ে কুড়ুল না মারতে। আজ কিন্তু সোম একদম sure যে chemistry পড়তে এসে সে একদম ঠিক কাজ করেছে। বিষয়টা তার দারুন লাগছে তো বটেই , তার উপর একথাটাও তো ঠিক যে এটা না করলে মনির সাথে তার আলাপই হতো না। হয়তো একই জায়গা থেকে দুজনেই শহরে এসেছে বলে দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত বন্ধন তৈরী হয়ে গেছে। আজ সবে ছমাসের বন্ধুত্ব তাদের, তবু সোমের মনে হয় যেন ও কতদিন ধরে মনিকে চেনে । মনিও তার এই টাউনতুতো দাদাকে পেয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে - নইলে এই শহরের ভিড়ে বড় একা লাগছিলো তার। মাঝে মাঝে সোমের মনে হয় ও মনিকে ভালোবেসে ফেলেছে । ঠিক sure হতে পারেনা - আর তাছাড়া মনির দিক থেকে তার কি প্রত্যুত্তর হবে সেটা না জেনে এগোনোর সাহসও তার নেই! তাই junior মেয়েটিকে পড়া বোঝানোর অছিলায় সে প্রায়ই মনির বাড়ি আসে, আজ বিকেলে যেমন এসেছে!
"তবে এই যে আজকাল যখন তখন মাইকে মহালয়ার স্তোত্র বাজায় এটা আমার ঠিক ভালো লাগে না"
মনির এই অনুযোগের সাথে সোম পুরোপুরি একমত! সে বলে
"হ্যাঁ ! ভোরবেলা পঙ্কজ মল্লিকের গলা না শুনলে পূজো বলে মনেই হয় না! তাছাড়া আমরা ছোটবেলায় ভোরবেলা উঠে বোম ফাটাতাম । বড়রা বকলে দোহাই দিতাম যে ওটা social service যাতে ঘুমিয়ে থেকে কেউ মহালয়া মিস না করে । সেটা শুনে বড়রা হেসে ফেলতো তবে মাঝেমধ্যে মাথায় চাঁটিও খেয়েছি ।"
মনি বলে ওঠে "সত্যি ! ছেলেগুলো কি জ্বালাতনই না করতো! বোম তো ফাটাতোই - তার উপর বাবার আদরের স্হলপদ্ম গাছের সব ফুল চুরি করে নিয়ে যেত!"
একটু থেমে মনি বললো "একবার কি হলো জানো! তখন আমার সাত কি আট বছর হবে। পাশের পাড়ার একটা বড় ছেলে - আগেও দেখেছি ওকে। এমনিতে বেশ ভালোই লাগতো, তবে কথা বলা হয়নি কখনো। দেখি, আমাদের বাড়ি থেকে ফুল সরাচ্ছে! প্রথমে একটু লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম - হোক না ফুলচোর , কিন্তু তাই বলে..."
মনি কথা শেষ করার আগেই সোম প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো "আরে! তুমি আমার গল্পটা শোনো! পাশের পাড়ায় একটা বদমেজাজি লোক প্রায়ই ফুল তোলার জন্য আমাদের বকাবকি করতো। আমিও এক মহালয়ার দিন সকালে গাছের সব ফুল ঝেড়ে দিয়েছি ! কাটতে যাব হঠাৎ শুনি খুব মিহি গলায় কে বলছে - চোর ! চোর ! তাকিয়ে দেখি বাড়ির জানলায় পা ঝুলিয়ে বসে একটা ছোট্ট মেয়ে আমাকে দেখে প্রাণপনে চেঁচাবার চেষ্টা করছে। হয়তো ভয়ে, নাহয় লজ্জায় গলা দিয়ে আওয়াজ বিশেষ বেড়োচ্ছে না! কিন্তু কি মিষ্টি লাগছিলো মেয়েটাকে কি বলব ! আমি তো বরাবর boys schoolএ পড়েছি, মেয়েদের সাথে তখনও বড় একটা কথা বলতাম না। কিন্তু ওকে দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পায়ে দিলাম ফুলটা বুলিয়ে । বোধহয় ওর সুরসুরি লেগেছিল -কেমন একটা শিউরে উঠলো! তারপর আর কি - ওর পায়ের কাছে ফুলটা ফেলে এক ছুট! তারপর কতবার ওপাড়ায় গিয়েছি জানো কিন্তু আর কখনও ওর দেখা পাইনি ! আজও বোধহয় ওর কথা ভেবেই..."
কথা বলতে বলতে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সোম যে খেয়াল করে নি কখন মনি খাট থেকে উঠে গেছে। জানলা দিয়ে তখন ভেসে আসছে "রম্যকপর্দিনী শৈলসুতে"! আস্তে আস্তে আলমারি খুলে মনি বার করে আনল তার ছোটবেলার বই "আম আঁটির ভেঁপু"। এগিয়ে দিল সোমের দিকে। মনির চোখের কোণ তখন অস্বাভাবিক ভাবে চিকচিক করছে। খোলা পাতার ভাজে সোম দেখল - শুকিয়ে যাওয়া একটা স্থলপদ্ম!