বসন্তের কবিতা

Tousif Islam, 13MS

25/09/2019

কবিতাটা থমকে আছে। বন্ধের দিনে স্টেশনে আটকে পড়া অসহায় ট্রেনের মত। দুই লাইন-এর পর এগোতেই চাইছে না। শব্দরা ছটফট করে। গন্তব্যে পৌছনোর তাগিদ সবার ভিতরেই থাকে কম বেশি। তবু কেউ কেউ একটু অন্যরকম। আটকে পড়া ট্রেনের জানলায় আলসে হেলান দিয়ে তারা মানুষ দেখে। হরেক রকম মানুষ। কবিতার ছন্দেরা তেমন। গা এলিয়ে আরাম করে বসে ওরা । চেয়ে চেয়ে দেখে আমার চোখে চিন্তার ভিড়, আমার কলমের আত্মসমর্পণ।

তুমিই বলেছিলে কবিতাটা লিখতে। লিখব লিখব করে লেখা হচ্ছিল না কিছুতেই। হোমওয়ার্ক আর ক্লাস টেস্ট এর ফাঁকে সময় করে ওঠা খুব মুস্কিল। এই মিডসেমটা শেষ হল আজ। ভাবলাম তাহলে লিখেই ফেলি কবিতাটা। সামনের সপ্তায় তোমার জন্মদিন আসছে। তখন নাহয় শোনানো যাবে পড়ে।

বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লাম টেবিল ছেড়ে। বিকেল শেষ হয়ে এসেছে প্রায় । আজ পুরো আকাশটা টকটকে লাল। বসন্তের বিকেলে মেঘে মেঘে জেগে উঠেছে সিঁদুরের গল্প। আমি লাল টি শার্টটা গলিয়ে নিয়ে সাইকেল বের করি । নদীর ধারে সব বন্ধুরা জড়ো হয়েছে এতক্ষণে। আজকাল বলতে গেলে প্রতিদিনই আড্ডার আসর বসছে বেশ। ওখানে গেলে সময়টা নিমেষে কেটে যাবে। মা চিল্লে ওঠে, ' ফেরার সময় দুধের প্যাকেটটা নিয়ে আসিস। ' 'আনবখন', আমি বেরিয়ে যাই।

আমায় দেখেই বিতান চিৎকার করে ওঠে, 'এইতো , লাটসাহেব চলে এসেছে। কবিতা হোক কটা । ' আমি হাসি, 'দূর'। নদীর ধারে গাছের তলায় আমার প্রিয় জায়গায় গিয়ে বসে পড়ি। জল ছুটে যায় আমার সামনে দিয়ে। মোহ, মায়া, যুদ্ধ, অশান্তি, সীমান্ত বিরোধ - কোনও কিছুর পরোয়া তার নেই। পাঠ্যবইয়ে লেখক জিগ্যেস করেছিল , 'নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?' সে প্রশ্নের উত্তর মিলে গেছে বহুযুগ আগেই। আজ আমার মনে জাগে অন্য জিজ্ঞাসা। যা চলে যায় একবার, তা কি ফিরে আসে কোনো কালে ?

গানে গল্পে শিঙাড়ায় তিনটে ঘণ্টা ফুস করে উড়ে যায়। সবাই উঠব উঠব করছি। আমার সেলফোন শব্দ করে ওঠে। মেসেজ । ' জানো, এখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে মুম্বাইয়ে।

রাত গভীর হয় । আমি টেবিলে একাকী বসে থাকি। পাশের ঘরে মা শুয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ । মাঝের ড্রয়িং রুমে মৃদু আলোটা জ্বলছে চুপচাপ। বাইরে বাতাসে আদিম গুনগুন। কান পাতলে শোনা যায় অশরীরীদের গল্প । আমার খাতায় তখন শব্দ এসে ঝরে পড়ে। ঠিক যেমনটি তুমি চাও। সে শব্দের আগুনে আমি পুড়ি। পোড়া আঙুলে ধরা কলম ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত ছিঁড়ে খায় আমার ভাবনা। ছন্দরা বাঁধনছাড়া বাছুরের মত নেচে বেড়ায় সারাটা ঘরে। আমি বাঁধা দেবার চেষ্টা করি না একটুও । ওরা আপন খেয়ালে বাতাসের তালে তালে খুঁজে নেয় অচেনা পথ। আর আমি ওদের দেখতে থাকি। অপলক। একটু একটু করে আমার কল্পনার দুনিয়াটা ফুটে ওঠে দস্তা কাগজে

কবিতাটা শেষ করতে মন চাইল না। শেষ লাইনটা অপেক্ষায় রইল দিগন্তে। সবকিছু হঠাৎ শেষ হয়ে গেলে ভাল লাগে না। অসীম শূন্যতা আমার নাপছন্দ। কিছু যদি বাকি রয়ে যায় এ যাত্রায়, ক্ষতি কি!

শুতে যাবার আগে মুঠোফোনটা হাতে নিই একবার। ' শুভরাত্রি। আরো বৃষ্টি ঝরুক তোমার শহরে। ' অদ্ভুত এক তৃপ্তি নিয়ে আমি বিছানায় যাই। আজ অনেকটা ঘুমাব। কাল আর কলেজ যেতে ইচ্ছে করছে না।

জোলো হাওয়া এসে হাত বুলিয়ে যায় চুলে। চোখের সামনে হাতছানি দেয় নীল সমুদ্র। সে আহ্বান ছেলেবেলায় ঝড়ের দিনে বড়বাড়ির বাগানে আম কুড়নোর মতই লোভনীয়। দূরের বন্দরে একটা একটা করে জাহাজ ছেড়ে যায়। সবার গন্তব্য আলাদা। মধ্যপ্রাচ্য, চীন, মালয় অথবা বোধহয় আফ্রিকা । আমি চেয়ে থাকি ওদের যাওয়ার পথে; যতক্ষণ না ওরা দিগন্তরেখায় অদৃশ্য হয়ে যায় মেঘেদের ভিড়ে। পুবালি বাতাস ফিসফিস করে ওঠে কানেকানে , ' এখুনি যেও না যেন, কবি। ও ঠিক আসবে। দেখো। '

আমি বিশ্বাস করে নিই কথাটা। পাথরের উপর বসে পড়ি ঝপ করে। অপেক্ষা বড় সুন্দর।

কানে আসে চুড়ির আওয়াজ। পিছু ফিরে দেখি পথের বাঁকে এক চেনা মানুষ। লাজুক হাসি নিয়ে তুমি এগিয়ে আসো। আমিও এগিয়ে যাই দুই পা।
' বলেছিলাম না, আসব।' তুমি আলতো করে কথা কও।
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। কত কথা বলার আছে। কোনমতে বলি, ' ভাবলাম, এবার বুঝি আর দেখা হল না। ' গলা কেঁপে ওঠে।
দিনের শেষ আলো থমকে যায় মুহূর্তের জন্যে। সমুদ্র হয়ে ওঠে নীরব। জ্বলে ওঠে বাতিঘরের আলো। গোধূলিবেলায় পরস্পরের হাত ধরে আমরা যে রঙিন স্বপ্ন দেখি, সে স্বপ্নেই তখন আমাদের বসন্ত উৎসব। সে স্বপ্নেই আমাদের আবির খেলা।

' কিরে কলেজ যাবি না ? ওঠ। আটটা বেজে গেল তো। '
মায়ের গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। বিভ্রান্তের মত কিছুক্ষণ বসে থাকি বিছানায়। একি দেখলাম ! আমার কবিতা ছায়াছবি হয়ে দেখা দিল স্বপ্নে! সকালের আলো আমায় জড়িয়ে ধরল শক্ত বাঁধনে। মা ঘর থেকে বেরবার আগে জানালার পর্দাগুলো সব খুলে দিয়ে গেছে।

আজ কথা হচ্ছিল নীপাকে নিয়ে। নীপা কে বিতান সেই স্কুলের দিনগুলো থেকেই পছন্দ করে। সায়নদার কাছে ইংরিজি টিউশন নিতে গিয়ে প্রথম দেখেছিল মেয়েটাকে। গার্লস স্কুলের নামজাদা মেয়ে ছিল নীপা । পড়াশুনাতে প্রথম তো হতই, কোনও এক বৃত্তিও পেয়েছিল সেই সময়। তার উপর অসাধারণ গানের গলা। বিতান তো পুরো ফিদা। প্রতিদিনই টিফিন পিরিয়ডে ও আমাদেরকে জোর করে শোনাত নীপার ট্যালেন্টের কথা। কোত্থেকে এত সব খবর পেত কোনোদিন বলেনি। জিগ্যেস করলে খালি এড়িয়ে যেত। ' সিক্রেট', বলেই চোখ মারত। আমরাও খুব একটা খোঁচাতাম না আর। এমনিতেই চল্লিশ মিনিট ধরে নীপার কীর্তি কাহিনী শুনে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম। আনুয়াল পরীক্ষায় সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা করতে গিয়ে হিমসিম খেতাম বটে, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম প্রশ্নে যদি নীপার কৃতিত্ব আলোচনা করার সুযোগ থাকত, তাহলে আমি ( এবং বিতানের বাকি বন্ধুরা ) ইতিহাসে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতাম।

সেই নীপার বিয়ে পরের ডিসেম্বরে। বিতান কোনোদিন মনের কথাটা বলেনি ওকে। আমরা জোরাজুরি করলে বলত , 'কি হবে বলে? এই যে ভালোলাগাটা আজ আছে, ওর সাথে একদিন কথা বলার যে স্বপ্নটা আছে, সেটা তো মরে যাবে তাহলে ! আমি এই স্বপ্নটাকে ভীষণ ভালবাসি রে।' আমরা থম মেরে যেতাম ওর কথা শুনে। ছেলেটা চিরকালই এমনি পাগল। নিজের মত ভাবে কত কিছু। আমাদের সাথে থেকেও অনেকটা আলাদা ও।

বিতান অবশ্য মুষড়ে পড়েনি। ও যেন জানত এমন হবে। যেন এমনটাই হতে হবে। নদীর ধারে বসে আজ ও গল্প শোনাল অনেক। সব পুরানো দিনের কথা। আমরা শুনলাম চুপ করে। ও বলল, 'এভাবেই শেষ করতে হয়। গল্প বলে। স্মৃতিকে ভালবেসে।'

যখন সন্ধ্যে নেমে এলো নদীর বুকে, ত্রিফলা জ্বলে উঠল অগোছালো, ওরা জিগ্যেস করল, ' তোর গল্প বল, ঋষি।'
আমি বললাম, 'সামনের সপ্তায় কলকাতা আসছে দিদার বাড়ি। আলাপ করিয়ে দেব ।'

' কাল কি নিয়ে আসব তোমার জন্য?'
' কিচ্ছু না।'
' শিওর ? কিচ্ছু না ? '
' আচ্ছা। মেঘ নিয়ে এস অনেকখানি। আমার কলকাতায় বৃষ্টি হয়নি বহুদিন। কালবৈশাখী দেখতে ইচ্ছে করে খুব।'
তুমি হো হো করে হেসে ওঠ।
' তুমি তো পুরো পাগলে গেছ দেখছি। কলকাতা গিয়ে তোমার মাথার নাট বলটু সব টাইট দিতে হবে। হুম।'
' সে নাহয় একটু টাইট দিলে। কিন্তু মেঘ আনতে ভুলোনাকো ।'
' বেশ । নিয়ে আসব। কি রঙের মেঘ চাও তুমি ?' , তুমি মজা করে জানতে চাও।
' সাদা। ধবধবে সাদা। ঐ মেঘে চড়ে আমি ভেসে যাব সিরিয়া, প্যালেসতাইনের উপর দিয়ে। মেঘ ভেঙে বৃষ্টি পড়বে ঝেঁপে। সেই বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে যাবে সব অস্ত্র আর অনাচার। '
' তুমি অনন্য।', মুগ্ধ উচ্চারণে অনেকটা ভালবাসা ভিড় করে।
কথা বলতে বলতেই ঘুম জড়িয়ে আসে দুই চোখে। আমি বালিশটা কাছে টেনে নিই। মুঠোফোন জেগে থাকে একা।

' কিরে - উঠে পড় বাবা। আজ দেবলীনা প্রথমবার আসবে এই বাড়িতে। ঘরদোর একটু গুছিয়ে রাখ। কি অবস্থা করে রাখিস সব। '

উঠে পড়ি বিছানা ছেড়ে। ' কখন পৌছবে রে ও ?' , মা জানতে চায় ঔৎসুক্যের সাথে। জিজ্ঞাসায় ঝরে পড়ে মমতা।
' এগারোটাও তো বাজেনি এখনো। বলল তো যে সাড়ে এগারোটায় ল্যান্ড করবে কলকাতায়। দিদার বাড়ি পৌছতে পৌছতে ধরো একটা তো বেজেই যাবে। আমি বিকেল বিকেল বেরবো ওকে আনতে। সন্ধ্যের মধ্যেই হাজির হব আমরা। ' মা খুশি হয় আমার কথা শুনে। দেবলীনার সাথে আলাপ করার ইচ্ছা মায়ের বহুদিনের। যদিও ফোনে দু একবার কথা হয়েছে। কিন্তু তাতে মায়ের মন ভরেনি।

মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ড্রয়ার খুলে রঙিন কাগজগুলো বের করি। তার উপর খুদে খুদে অক্ষরে লিখে ফেলি বসন্তের কবিতাখানা। তারপর সোনালি ফিতেই বেঁধে সযত্নে রেখে দিই টেবিলের উপর। দেবলীনা এসে চুপিচুপি আমার পকেটে দুধের মত সাদা মেঘ গুঁজে দিয়ে জানতে চাইবে , ' আমার কবিতা কোথায়, কবি ? ' আমি তখন ওর হাতে তুলে দেব এ উপহার। রঙিন কাগজ, সোনালি ফিতে দেখে ও ভীষণ খুশি হবে - আমি জানি।

কিছুক্ষণ আগেই দেবলীনা ফোন করেছিল। ট্যাক্সিতে আছে। এয়ারপোর্টে ব্যাগ কালেক্ট করতে একটু দেরি হয়ে গেছিল ওর। ঘণ্টাখনেকের মধ্যেই গিরিশ পার্কে ওর দিদার বাড়ি পৌঁছে যাবে।

টুকিটাকি কাজ সেরে স্নান করতে ঢুকি। কিছুক্ষণ বাদেই দরজায় দুমদাম ধাক্কা। 'বাবু, তাড়াতাড়ি বাইরে আয় একবার। কি হয়েছে দেখে যা একবার। মেয়েটাকে একটু ফোন কর।' আমি গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি। হৃদস্পন্দনটা ভীষণ বেড়ে ওঠে। কি হল আবার !

বারবার ফোন করছি ওকে। রিং হয়েই চলেছে। কেউ তুলছে না। মা উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। আমার হাত পা ভীষণ ভারি হয়ে আসছে। মায়ের ঐ দৃষ্টি আমি আর নিতে পারছি না একটুও। ভালবাসা, মমতা - এগুলোও তাহলে হেভি হয়ে ওঠে কখনো সখনো। আমি ড্রয়িং রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আসি। কুঁকড়ে বসি আমার খাটের কোণে। আরও একবার ডায়াল করি নাম্বারটা।

রিং হতেই থাকে। আদি-অনন্তকাল ধরে। কেউ শুনতে পায়না সে শব্দ। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে টিভির আওয়াজ, গিরিশপার্কে উড়ালপুল ভেঙে পড়ার শব্দ । সে আওয়াজে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে ।।

অনেকটা ভালবাসা আমায় টেনে আনে নগর কলকাতায়।
তখনো জানিনা এ শহরে উড়ালসেতুর নিচে চাপা পড়ে প্রেমপত্র ।
লোহার জঙ্গলে যৌথ স্বপ্ন হারিয়ে যায় রক্তভেজা শিল্পে।
তোবড়ানো ট্যাক্সির নিচে ক্ষয়ে যায় সব কথা।

ময়দান বাকি রয়ে গেল, বাকি রয়ে গেল রোববার বিকেলে প্রিঞ্চেপঘাট।
গুছিয়ে রাখা মেঘেরা চেপ্টে যাওয়া জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।

আজ এই শহরে বৃষ্টি বড় প্রয়োজন।।

নোটঃ সেদিন ছিল বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে অনেক মানুষের চলে যাবার একবছর।