১
আমার ছোটবেলার পুজোটা আমার কাছে যত্ন করে রাখা ছিল অনেকদিন। আমার ছোটবেলার পুজোয় মেঘ করে আসার জো ছিল? চকচকে রোদ একটু হালকা হয়ে এলেই ছুট্টে যেতাম মেঘের সাথে ঝগড়া করতে। কখনও আমি জিততাম, কখনও মেঘ। আমার ছোটবেলার পুজোর আগ দিয়ে মহালয়ার আগের রাতে পইপই করে মাকে শেখানো থাকতো পরদিন ভোর চারটে বাজতে দশে তুলে দেওয়ার কথা। অবশ্য ঘুম ভাঙতো নিজেই। বিছানা থেকে উঠে সোজা রেডিও চালিয়ে দিতাম বারান্দায়। ঘর থেকে বাবা বলতো, ঠান্ডা আছে, মশা কামড়াবে, বিছানায় উঠে গিয়ে শোন। বিছানায় উঠতাম, মশারীর মধ্যে, দিদার বিছানায়। দিদার গায়ে দেওয়া গরম চাদরের মধ্যে ঢুকে পড়তাম। বীরেনবাবুর জলদমন্দ্র কন্ঠ আমায় নাড়া দিত তখন থেকেই। আর সেই অদ্ভুত একটা ভোরে, সেই অপূর্ব একটা ঘোরের মধ্যে, দিদার গরম চাদরের তলায় চোখ লেগে আসত তন্দ্রায়। আর সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন কানে ভেসে আসত "রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো যহি" কিংবা "জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী"... দৈববাণীর মত মনে হত ঠিক। তন্দ্রা ভাঙত, ঐ একটি দিন দেখতাম জানলার ফাঁক গলে কীভাবে ভোর হয়, কীভাবে মা দুর্গা সত্যি সত্যি চলে আসে... ভোরের প্রথম আলোর সাথে, প্রথম স্নিগ্ধ হাওয়ায়, প্রথম শিশিরে, প্রথম ঝরে যাওয়া কিছু শিউলির পথ ধরে। জানলার ধারে সূর্যের প্রথম আলোয় দাঁড়াতাম। সত্যি সত্যি মনে হতো, এই তো, আজ থেকে পৃথিবীর একটা অন্য গন্ধ, অন্য শক্তি, অন্যরকম আনন্দ। জোড়হাত করে মা দুর্গাকে বলতাম, আগামী একটা বছর সব্বাই খুব খুব খুশী থাক। তখন মা আমার কথা শুনতো।
তারপর টিভি চালাতাম। এবার বারণ না শুনে এসে বসতাম বারান্দায়। দিদা উঠতো না। বলতো, পর্দাটা সরিয়ে দে তো, দেখি। পর্দা সরাতাম। আমরা মহালয়া দেখতে দেখতেই সবাই উঠে পড়তো।
২
আমাদের একটা টেপ রেকর্ডার ছিল, এখনও আছে। ক্যাসেট থাকলে এখনও বাজবে নিশ্চয়ই। এটা নিয়ে অনেক গল্প আছে। আমার ছোটবেলায়, যখন আমাদের সাদা কালো টিভি, কিংবা রঙিন টিভি আসার পরেও প্রোগ্রামের এত বাড়বাড়ন্ত হয়নি, তখন রাতে সবাই মিলে খেতে বসার সময় মামা কিংবা বাবা সেই টেপ রেকর্ডারে গান চালিয়ে দিত, রবীন্দ্রসঙ্গীত। কয়েকটা গানের পর ক্যাসেট উল্টে দিতাম। আমার কাছে সব গানই তো নতুন! তাই প্রত্যেকটা গানের শেষেই আমার জিজ্ঞাসা, এবার কী গান? ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বহু ছবির ভিড়েও স্পষ্ট মনে আছে মামা একদিন উত্তরে চারটি শব্দ গেয়ে বলেছিল, "মম চিত্তে নিতি নৃত্যে"... তার আগে বা পরে মামাকে এখনও কিছু গাইতে শুনিনি।
আরেকটা গান বাজত, "বাদল বাউল বাজায় বাজায় বাজায় রে, বাজায় রে একতারা/ সারা বেলা ধরে, ঝরো ঝরো ঝরো ধারা"... সেই ছোট্টবেলার ক্যাসেটের পরে এই গানটি আমি দীর্ঘ দীর্ঘদিন শুনিনি। তবে ঠিক এই দুটো লাইন মনে ছিল। এই গানটি আবার নতুন করে শুনলাম মাত্র কয়েক মাস আগে, এত এত বছরের পর, অন্যভাবে, সেই ছোটবেলার ছবিগুলো ফিরিয়ে দিয়ে গানটি ফিরে এল। এভাবেই ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ, ফিরে আসবেন, যত দিন যাবে।
আমাদের সেই টেপ রেকর্ডারে মহালয়ার পরদিন থেকে একদম নবমীর সকাল পর্যন্ত দিদা মহালয়ার ক্যাসেট চালাতে বলতো। তাই প্রতিটি সকাল শুরু হত সেই মন ভালো করে দেওয়া সুরেই। আমি বলতাম, বছরের মাঝে হঠাৎ করে একদিন, যখন পুজো বহুদূরে, তখন মাঝে মাঝে মহালয়া চালালে দারুণ হয় না! দিদা বলতো, ধুর বোকা, যখন পুজো আসব আসব করে, তখনই তো শুনতে হয়। পুজো আসছে ভাবতে যে মজা, পুজো এসে গেলে তো তা নেই, কেমন ফুস করে ফুরিয়ে যায়। আমারও ঠিক একই কথা মনে হত।
আসলে আমার ছোটবেলার পুজো শুরু হয়ে যেত বহুদিন আগেই। বর্ষার শুরুর দিকেই যখন আসা যাওয়ার পথে দেখতাম আজ বাঁশ বাঁধছে, আজ খড়, এই তো আজ মাটি দিচ্ছে... তখন থেকেই আমার পুজো শুরু হয়ে যেত। পেপারওয়ালা দিয়ে যেত আনন্দমেলা, শুকতারা, বাবাও নিয়ে আসতো। তার গন্ধটাকে সযত্নে রাখতাম। বেশ গন্ধ নিয়ে নিয়ে, সন্তর্পণে পাতা উল্টে উল্টে পড়তাম, নতুন ব্যাপারটা যাতে হারিয়ে না যায়। আমি পড়তাম, বাবা দেশ-এর পাশাপাশি মাঝে মাঝে আনন্দমেলাও দেখতো, আর পড়তো আর একজন, খুব খুশী হয়ে... আমার দিদা...
৩
পুজো শুরু হওয়ার আগেই চলে আসত নতুন নতুন জামা। আমার ছোট্টবেলার পুজোয় জামা প্যান্টের সেট পেতাম। আর একটু বড় হয়ে গেলে সেট আর পাওয়া যেত না। তাই কখনও জামার চেয়ে প্যান্ট বেশী হত, কখনও প্যান্টের চেয়ে জামা! কবে থেকে যে ঝুলের মাপের প্যান্ট ছেড়ে কোমরের মাপের প্যান্ট কেনা শুরু হল, তা আর মনে পড়ে না।
পুজোর কেনাকাটায় দিদার ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। দিদাই স্কুল থেকে ফেরার পথে মাকে আনতে বলতো মা দুর্গার শাড়ী, অষ্টমীর পুজোর জন্য। মা নিয়ে আসতো। বাবা মার সাথে বেরিয়ে আমি কিনতাম জামা প্যান্ট, আর দিদার দেওয়া টাকায় কিনতাম অঞ্জলী দেওয়ার পায়জামা পাঞ্জাবী। আমার এক দিদিও প্রতিবার পুজোয় পায়জামা পাঞ্জাবীই দিত।
পুজোর ক'দিন আমার দম ফেলার ফুরসত থাকত না। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দু'বেলা ঠাকুর দেখতে বেরোনো ছিল বাধ্যতামূলক। আর প্রত্যেকবার নতুন পোশাক। সেই ছোট্ট থেকে আমার ঠাকুর দেখার সঙ্গী বাবা। বাবার হাত ধরে ঘুরতাম শহরের এ গলি থেকে ও গলি। আর সাধারণতঃ অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলা বেরোনো হত সবাই মিলে। একটা প্যান্ডেলে গিয়ে আমার দাঁড়ানোর সময়ই থাকত না, বারবার জিজ্ঞাসা করতাম, পরেরটা? অন্তত আমার জানা সব ঠাকুর দেখা না হলে মুখভার হত। আবার বেরোতে হত আমায় নিয়ে। একটু বড় হওয়ার পর ষষ্ঠী সপ্তমী কলকাতার পুজো দেখতাম। সপ্তমীতে ফিরতাম কৃষ্ণনগর। অষ্টমীর সকালে পাড়ার পুজোয় অঞ্জলী দেওয়া ছিল অাবশ্যিক।
দিদা রোজ বেরোতো না। কেবল অষ্টমীর সকালে আমার এক মাসি গাড়ী নিয়ে দিদাকে পাড়ার দু তিনটি পুজো দেখিয়ে আনত। তাই ঠাকুর দেখে ফিরেই ঠাকুর দেখার গল্প করতাম দিদার সাথে। ছবিও দেখাতাম ক্যামেরা বা ফোন থেকে, কখনও বা টিভিতে সেট করে। দিদা রোজ দূরদর্শনে বেলুড় মঠের পুজো দেখতো। প্রায়ই চলত নানা চ্যানেলের পুজো পরিক্রমা। আমিও দেখতাম। যত বেশী সম্ভব ঠাকুর দেখে নেওয়ার মজাই ছিল অন্যরকম, সচক্ষেই হোক বা পর্দায়। পুজোর দিনগুলোয় এক মুহূর্ত ঘরে বসে থাকা আমার কাছে ছিল সময়ের চরমতম অপচয়।
৪
দিদার কাছে শুনতাম বাংলাদেশের পুজোর গল্প। দিদার দেশের বাড়ীতে দুর্গাপুজো হত, দিদা যখন ছোট্ট ছিল, সেই তখন। ছোট্ট আমি শুনতাম ছোট্ট দিদার গল্প। নৌকো করে রাজশাহী থেকে দেশের বাড়ী কলমে যাওয়া, পুজোর জিনিসপত্র আনা, বলিদানের সময় ছোট্ট দিদার ভয় পেয়ে লুকিয়ে থাকা, গভীর রাতের সন্ধিপুজো, আর সবাই মিলে ভরপুর আনন্দ--সেইসব কথা। সেই থেকে আমার ভীষণ আক্ষেপ, কেন আমাদের বাড়ীতে দুর্গাপুজো হয়না... ছোটবেলার আমি ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে বড় হয়ে বাড়ীতে একটা দুর্গাপুজো করবই করব। সেই দীর্ঘ ভবিষ্যতের ভরসায় ফেলে না রেখে প্রস্তাবটা যে তখনই দু একবার উত্থাপন করিনি, তাও নয়। কিন্তু বলা বাহুল্য, সেই প্রস্তাব ধোপে টেকেনি।
আসলে ছোট থেকে আমার লোকজন খুব ভালো লাগে, খুব হৈ-চৈ, খুব মজা, অনেক কথাবার্তা, গল্পগুজব। তার কিছুটা পেতাম লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজো আর ভাইফোঁটায়। চিরকালই একান্নবর্তী পরিবারের প্রতি আমার খুব আকর্ষণ। তাই চাইতাম পুজো। বনেদি বাড়ীর মত পুজো, সবাই মিলে পুজো। আমাদের ছ'জনের ছোট্ট সংসারে (ভাগ্যিস অন্তত নিউক্লীয় নয়) যদি পুজোর মধ্যে দিয়ে আবার বৃহত্তর পরিবারের বাকী সবাই মিলিত হয়, সেই স্বপ্ন মনে মনে সবসময় বুনে চলতাম। তাই দিদার বাড়ীর পুজোর গল্প ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মত সুন্দর।
বাড়ীর পুজোর স্বপ্নপূরণ না হলেও বেশ আনন্দেই পুজো কাটতো। অষ্টমীর সকালে সেজেগুজে অঞ্জলী দেওয়াটা আমার কাছে ছিল একটা খুব মজার ব্যাপার। আমার ছোট্টবেলায় একবার নাকি মন্ত্র বুঝতে না পেরে অদ্ভুত শব্দ করে অঞ্জলী দিয়েছিলাম। পুরোহিতমশাই রাগ করেছিলেন কিনা জানিনা, কিন্তু মা দুর্গা কিচ্ছুটি মনে করেনি। তখন মা আমায় পাপ দিতনা। আমারও পাপ ছিলনা নিশ্চয়ই।
মন্ত্রোচ্চারণ আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস। খুব তাড়াতাড়িই আমি নানারকম মন্ত্র শিখে গিয়েছিলাম। তাই ধীরে ধীরে অঞ্জলীর মন্ত্রগুলো পরিষ্কার হয়, ভালোভাবে অঞ্জলী দিতে শিখি। তবে প্রণামমন্ত্র মাঝে মাঝে ঠাকুরমশাই এত তাড়াতাড়ি বলতেন, যে তার কিছুটা অনেক সময়ই বাদ পড়ে যেত। আমার জানা মন্ত্রগুলো জোরে জোরে বলতাম। মন্ত্রোচ্চারণে একটা অন্যরকম শক্তি, অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। আর যে মন্ত্রগুলো বলতে পারতাম না, তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। মা আমায় ক্ষমা করতো।
৫
মা দুর্গার সাথে আমার অনেক অনেক গল্প ছিল। অনেক কিছু ছিল বলে দেওয়ার, অনেক কিছু ছিল চেয়ে নেওয়ার। হাত জোড় করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, নিজের মনেই কত কিছু বলতাম মাকে। মা-ও শুনত। দিদা যেকোনো পুজোতেই ঠাকুরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর বলতো, দ্যাখ দ্যাখ, ঠাকুরের মুখটা কেমন বদলে গেল... কী সুন্দর হাসছে দ্যাখ ঠাকুর। সত্যি সত্যি দেখতাম। দেখতে পেতাম মা দুর্গা কেমন সুন্দর করে হাসিমুখে চেয়ে আছে। বিসর্জনের সময় ঘট নড়িয়ে দেওয়ার পর দিদা বলতো, দেখেছিস, মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল ঠাকুরের। এখন তো ও মাটির পুতুল হয়ে গেল। মা দুর্গার মুখ শুকিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করতাম নবমী থেকেই। আর দশমীতে যেন মা কাঁদত। প্রতিমার মুখের চকচকে ভাবটা যেন চোখের কোণায় চিকচিকে জল হয়ে ধরা দিত।
মায়ের কথা আমি বুঝতাম, আমার কথাও মা বুঝতো। প্যান্ডেলে মাঝে মধ্যে একা একা গিয়ে মায়ের চোখের দিকে চেয়ে মনের কথা বলতাম। দেখতাম, মায়ের মুখের হাসি কখন বড় হয়, কখনও একটুও কমে আসে কিনা। তখন সত্যি মা আমার কথা শুনতো, আমিও হয়তো মায়ের কথা শুনতাম।
৬
পুজোর ক'দিন পড়াশোনার বালাই ছিল না। দশমীর দিন সকাল সকাল সবাইকে প্রণাম করে, খাতার পিছনে ঠাকুরের নাম লিখে পড়াশোনা শুরু হত। সেদিন নাকি সব বিষয়ই একটু একটু পড়তে হয়। তাই ভারী একটা বুদ্ধি বের করেছিলাম। সব বিষয়ের বই খুলে একটা করে লাইন পড়ে রেখে দিতাম। একটিমাত্র সোজা অঙ্ক করে রাখতাম। পুজো শেষ হয়ে গেলে খুব কষ্ট হত, মা দুর্গা গত চারদিনের সমস্ত আয়োজন, সমস্ত জাঁকজমক ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে বলে তো বটেই, আরও বেশী কষ্ট হত আবারও রোজকার জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে হবে, এই ভেবে।
আমার ছোটবেলার পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যেত বিজয়ার দিন থেকেই। অনেক সময় জানতাম না পরের বার পুজোর সঠিক তারিখ। তাই ১লা জানুয়ারী নতুন বছরের ক্যালেন্ডার পাওয়ার সাথে সাথেই প্রথম কাজ ছিল পুজো কবে দেখে নিয়ে ক'দিন বাকী হিসেব করা। মামীর একটা পুরোনো আলমারী ছিল, যেটা ছিল আমার কল্পনার স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড। আমি যা যা পড়তাম, শিখতাম, ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে আমার অদৃশ্য ছাত্রদের পড়াতাম। পরীক্ষার প্রশ্ন দিতাম বেশ কঠিন করে। আলমারীর বাইরেটা খসখসে হয়ে যাওয়ায় সেখানে চক দিয়ে সহজেই লেখা যেত। সেই ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতাম, প্রতীক্ষার আর কতদিন। প্রতিদিন সংখ্যাটা ১ করে কমতে কমতে যখন ৩..২..১..০.. হয়ে যেত তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, এত তাড়াতাড়ি একটা গোটা বছর কেটে গেল!
বিজয়ার দিন দিদার ব্যস্ততার অবধি থাকত না। মামাকে বাজারে যাওয়ার সময় বারবার বলে দিত মিষ্টি আনতে, টাকা দিয়ে দিত, বিজয়ার মিষ্টি দিদাই খাওয়াতো। বিজয়ার দিন বাড়ীতে আসত কুচো নিমকি, মিহিদানা, সীতাভোগ, রসগোল্লা, পান্তুয়া-- এত কিছু। দিদাকে বিজয়ার প্রণাম করতে আসত অনেকেই। আমার মতই লোকজন বড় ভালবাসত দিদা। আমি সবাইকে প্রণাম করতাম। প্লেটে করে সবার সাথে খেতাম নিমকি, মিষ্টি। তার আনন্দই ছিল অন্যরকম। অনেকের বাড়ীও যেতাম প্রণাম করতে। পাশেই বড়মাসির বাড়ী, আরেক মামীর বাড়ী... সেখানেও পেটপুজো... নিমকি, নারকেল নাড়ু, মিষ্টির লোভ কি কেউ ছাড়তে পারে?
৭
বিজয়ার দিন বিকেলে মা আর মামী পাড়ার মন্ডপে মা দুর্গাকে বরণ করতে যেত। আমিও যেতাম সাথে। সব ঠাকুরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম। সব ইচ্ছে জানাতাম মনে মনে। মা আর মামী সকলের সাথে সিঁদুর খেলত, সব ঠাকুরকে খাইয়ে দিত সন্দেশ। আমারও গালে, কপালে সবাই লাগিয়ে দিত সিঁদুর। মা দুর্গার পায়ের ফুল নিয়ে আসতাম। বাড়ী এসে সবার মাথায় ফুল ছুঁইয়ে প্রসাদ খাওয়া হত। মন্ডপে যেতে কোনোবার একটু দেরী হতে দেখলে ব্যস্ত হয়ে উঠত দিদা।
আমাদের পাড়ার ঠাকুরকে নিয়ে যাওয়া হত বিকেল বিকেলই, বাড়ীর সামনে দিয়ে। দিদা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত, কখন ঢাকের আওয়াজ শোনা যায়... মোড় থেকে ঢাকের আওয়াজ কানে আসতেই সবাই মিলে দাঁড়াতাম দরজায়, দিদাকেও ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হত। দিদা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত যতক্ষণ মা দুর্গার মুখ প্রাচীর ছাড়িয়ে মিলিয়ে না যায়। ওটুকু ছিল দিদার পরম প্রতীক্ষিত কয়েক মুহূর্ত, মা দুর্গাকে অত কাছ থেকে দেখার সামান্য অবকাশ। তারপর ঘরে এসে টিভিতে দেখা হত বেলুড় মঠের প্রতিমা নিরঞ্জন। বিসর্জনের সময় দিদা তো মা দুর্গার চোখে জল দেখতে পেত, মা দুর্গা দিদার চোখের কোণে চিকচিকে জল দেখতে পেত কি?
৮
আমার ছোটবেলার পুজোয়, যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, ছ'বছর বয়স, তখন আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় স্থানীয় একটি ক্লাবের পূজাপত্রিকায়। আমার মেজোমেসো ছিল সেই ক্লাবের সদস্য, যতদূর সম্ভব তখন ছিল সহ-সভাপতি। মেজোমাসি (যাকে আমি একদম ছোট্ট বয়স থেকেই কেন জানিনা নাম ধরে ডাকতাম) আমার কবিতাটি নিয়ে গিয়ে মেসোর মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমার নিজের হাতের লেখায়, বাদামী অক্ষরে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল সেই পত্রিকায়। এখনও কবিতাটির প্রথম দুটো লাইন মনে আছে:
"দুর্গাপূজা বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব,
দুর্গাপূজা মানেই হল ঢাকের কলরব..."
আমার ছোটবেলায় বাড়ীর দেওয়ালগুলো ছিল আমার লেখা আর আঁকার জায়গা। মামার ঘরের দেওয়ালে এই দুটো লাইন দীর্ঘকাল প্যাস্টেল রঙে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ছিল। অবশ্য ঘর রঙ হওয়ার পরে সেই লেখা মুছে গেছে, সেই পত্রিকাটিকেও আর দেখিনা।
এর প্রায় দশ বছর পরে, তখন ক্লাস ইলেভেন, পুজোর ক'দিন আগে রাত আটটা নাগাদ বুম্বাদা ফোন করে বলল ওদের ক্লাবের পুজোসংখ্যায় লেখার জন্য। পরের দিন সকালে পড়তে গিয়েই দিতে হবে লেখা। রাত বারোটায় লেখা শেষ হল। কেমন অজান্তেই খুব ছোটবেলার একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল, তা সেদিন ভেবে দেখিনি।
৯
আমার ছোটবেলার পুজোয় প্রতি বছর বাজী পোড়ানো ছিল নিশ্চিত। প্রতি বছর কিছু বাজী জমিয়ে রাখতাম। ইচ্ছে হত, বছরের মাঝামাঝি, যখন কোনো উপলক্ষ্যই নেই, তখন হঠাৎ একদিন বাজী পোড়াব। তবে সে আর হয়ে উঠত না। তাই এক বছর কালীপুজোয় জমানো বাজী রয়ে যেত পরের বার দুর্গাপুজো পর্যন্ত। সবাই বলত, বাজী জ্বলবে না, স্যাঁতসেঁতে হয়ে এতদিন থাকে নাকি? কিন্তু আমি বাজীগুলোকে পেপার পেতে রোদে দিতাম পরপর দু' তিনদিন--ছাদে কিংবা উঠোনে। মোটামুটি সব বাজীই জ্বলত ঠিকঠাক, আমার মান রাখত। আমার মুখে ফুটে উঠত বিজয়ের হাসি।
নতুন বাজীও আসত বৈকি। পুজোর ক'দিন আগে বাবার সাথে বাজী কিনতে যেতাম। বাবা কিছু দিত, আর কিছু বাজীর টাকা দিয়ে দিত দিদা। বারবার বলে দিত, যত ইচ্ছা বাজী কিনবি, তবে আলোর বাজী, শব্দের নয়। আমারও আলোর বাজীই পছন্দ, শব্দবাজী কোনো কালেই মনে ধরত না। চকলেট বোম, কালীপটকার আওয়াজে যারপরনাই বিরক্ত হতাম। তার থেকে অনেক ভালো তুবড়ি, রঙিন আলোর পুঞ্জীভূত উচ্ছ্বাস যেখানে মুহূর্তে আকাশ ছুঁতে ওঠে। কিংবা ভালো চরকি, এক পলকে সারাটা উঠোনকে কেমন ভরিয়ে দেয় আলোর পাকে। কিনতাম রংমশাল, রকেট, তুবড়ি-চরকি ধরানোর লাল-হলুদ-সাদা ফুলঝুরি। মাঝে মাঝে নতুন নতুন বাজী উঠত, ট্র্যাফিক সিগন্যাল, তিনরঙা রঙমশাল এইরকম। সেইসব বাজী কিনে আনতাম। আর আনতাম কয়েক প্যাকেট মোমবাতি।
সন্ধ্যে হতে না হতেই বাবার সাথে উঠোনে গিয়ে শুরু হত বাজী পোড়ানো। মাঝে মাঝে ঘর থেকে দেখত সবাই। নাকে রুমাল বাঁধতাম বাবার নির্দেশে, যাতে ধোঁয়া না ঢোকে। রকেট, তুবড়ি আর চরকি ধরানোটা ছিল ভারী মজার। সাবধানতার জন্য মাঝে একটা মজার উপায় বের করেছিলাম। বাড়ীতে একটা লাঠির আগাটা ছিল একটু চেরা। সেখানে ফুলঝুরির কাঠি অংশটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে দূর থেকে বারুদ অংশটাকে ধরতাম প্রথমে মোমবাতিতে, আর সেটা ধরে গেলে তুবড়ি, চরকি বা রকেটে লাগিয়ে দিতাম। অবশ্য খুব বেশী বার এই পথ অনুসরণ করা হয়ে ওঠেনি।
১০
মায়ের কাছে একটা অ্যালবাম আছে। তার মধ্যে সযত্নে রেখে দেওয়া আছে একটা সুন্দর সময়। রেখে দেওয়া আছে ২১ দিন থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত আমার একটা নিশ্চিন্ত যাত্রাপথ। নিশ্চিন্ত, কারণ সত্যিই কোন চিন্তা ছিল না, রোদ ছিল না পথে, দিদা দাঁড়িয়েছিল ঠিক যেন বটগাছের মত, সুদূরপ্রসারী, দিগন্তবিস্তৃত শীতল ছায়া দিয়ে। সেসব দেখি আর অবাক হই। যে ছেলেটা অমনভাবে দ্বিধাহীন হাসতে পারত, সে কি সত্যি আমি? অথচ আমার তো কত কথাই মনে নেই! আমার ছোটবেলা, ছোটবেলার পুজো কি আমারই কাটিয়ে আসা সময়, নাকি একটা ভোরবেলাকার স্বপ্ন, যার কথা বহুদিন পরপর মনে পড়ে, যখন একলা মাঠের মধ্যে হাওয়া ওঠে উথাল-পাথাল? ভাবি, আর ছোটবেলাকার আমিটার উপর খুব হিংসে হয়।
এরকম হাজারো গল্প নিয়ে ভরা আমার ছোটবেলার পুজো। আমার ছোটবেলার পুজো ভরা আছে বাগান ভাসিয়ে দেওয়া শিউলির বন্যায়, ধুনো-কর্পূরের পাগল করা সৌরভে, বুকশেল্ফ ভরে থাকা পুরোনো ম্যাগাজিনে, অঙ্কে অঙ্কে ঠাসা পুরোনো খাতায়, টিউশনের ফেলে আসা সমস্ত পথে, হাজারো না-বলা-না-জানা কথায়, দিদার কাছ থেকে শোনা-না-শোনা হাজারো গল্পে, বীরেনবাবুর ভরাট গলায়, বুম্বাদার শোনানো "অমল-ধবল পালে লেগেছে মন্দ-মধুর হাওয়া" রবীন্দ্রসঙ্গীতে, আর চোখের পাতার নীচে জমিয়ে রাখা সহস্র মুহূর্তের স্বপ্নিল সজ্জায়। ওদের দেখতে পাই, চিনতে পারি, মনে হয় এই তো এইবার ছুঁয়ে দিয়ে যাবে-- অথচ ছোঁয়া হয়না, ছোঁয়া যায়না ওদের। ওরা একলা পৃথিবীর বুকে জন্মানো এক-একটা রূপকথা, ওরা আছে জানি, ঠিক যেমন জানি দিদাও আছে, অথচ কোথায় আছে জানিনা।
এইসব নিয়েই আমার ছোটবেলার পুজো। এইসব নিয়েই আমার বড় হওয়ার পুজো। সবার মধ্যে থেকেও হঠাৎ যখন একলা হই, ওরা তখনই ফিরে আসে, একটা যেন মনকেমনের হাওয়া বয়ে যায় ভেতর দিয়ে। অথচ সেই মনকেমনের জন্যই ওদের ধরে রাখি, ধরে রাখব, মায়ের সেই অ্যালবামের মত, সযত্নে, জীবনভর।